বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫

কেউ আমাদেরকে সারাজীবন ভালবাসুক! যদি আমরা চাই..

কেউ আমাদের ভালোবাসুক

   যদি তুমি কারোর দুঃখের কারন না হও তাহলে তুমি তোমার নিজের জীবনে নিজের স্বাধীন মত বেচে থাক। আমরা ভাবি অন্যের জন্য বেচে থাকার নামই জীবন। তাই অন্য আর একজনকে সুখী করতে, আমাদের থেকে তাদের আশাকে পূর্ণ করতেই আমরা আমাদের জীবন কাটিয়ে দেই। নিজের সুখের কথা না ভেবে শুধু অন্যের জন্য কাজ করতে করতে আমরা হাপিয়ে যাই, তখন আমাদের মনে শান্তি থাকে না। আর সেই অশান্তির জন্য যখন আমরা তাকে দায়ী করি, তখন তার প্রতি ভালোবাসাও শেষ হয়ে যায়।
     যদি সম্পর্কে ভালবাসা না থাকে তবে সেই সম্পর্ক বেশি দিন টেকে না। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাবার অন্যতম কারন হয় অন্যকে সুখী করার চেষ্টা। যদি সে সুখী হয় তবে আমি সুখী, যদি সে সুখী না হয় তবে আমি সুখী নই।
    আমরা যদি চাই কেউ আমাদেরকে সারাজীবন ভালোবাসুক তবে আমাদের সুখী করতে তাকে কিছু করতে বল না, তাকে সম্পুন্ন স্বাধীনতা দাও। আমাদের সুখী করার চেষ্টা ধীরে ধীরে তার মন থেকে ভালবাসা মুছে দিতে পারে, তবে স্বাধীনতা তার সহজাত প্রবৃত্তিকে বজায় রাখে, তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে যায় না, তাকে তার নিজের মত থাকতে সাহায্য করে।
    আমি জানি অন্যের কাছ থেকে আমাদের কিছু প্রত্যাশা থেকেই যায়, তাই অনেকে ভাববে সেই প্রত্যাশা মুছে দিয়ে কাউকে স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। আমাদের সঙ্গীর কাছ থেকে আমাদের অনেক আসা থাকতে পারে তবে তাকে পুরন করার জন্য তার উপর আমরা জোর করতে পারি না। যদি কোন কাজ করতে তার ইচ্ছা না করে তাহলে সেই কাজ করতে জোর করা আমাদের ভালবাসার পরিচয় নয়।
     যদি সেই কাজ করা খুব জরুরী হয়ে থাকে তাহলে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর যতক্ষন অবদি না সে সেই কাজ নিজে ইচ্ছায় করতে চায়। তাকে বোঝানোর চেষ্ঠা কর সেই কাজটা তোমার কাছে কতটা জরুরী, সে তার হাতে সেই কাজটা সম্পন্ন করলে তোমার কতটা সুবিধা হবে। সে যদি তোমাকে ভালবাসে তখন সেই কাজটা সে নিজের ইচ্ছায় করবে। তুমি কি চাও তুমি যাকে ভালবাস সে নিজের ইচ্ছায় কাজ করুক, নাকি তার উপর জোর করে তুমি কাজ করাও?
     যে মন স্বাধীন থাকে সেখানে তার প্রকৃত স্বভাব বজায় থাকে, তখন তার আত্মপরিচয় অক্ষুন্ন থাকে, তখন সেই মন ভালবাসতে পারে। তবে যেখানে তাকে চেষ্টা করতে হয়, অন্যের প্রত্যাশা পুরন করতে দৌড়ে বেড়াতে হয় সেই মন তখন ভালোবাসতে পারে না। তাই আমরা কাউকে স্বাধীনতা দিলে যত তার সহজাত স্বভাব বজায় থাকবে ততই আমরা তার থেকে ভালবাসা পাব।
     আমরা নিজেরা কখনো ভেবে দেখি না আমাদের পরাধীন থাকতে কেমন লাগে। একটি পাখিকে খাচায় পুরে রেখে তাকে ওড়ার একটুক জায়গা দিলে সে ভালবাসতে পারবে, নাকি তার ওড়ার জন্য একটি বিশাল আকাশ দিয়ে দিলে সে ভালবাসবে। সম্পর্কের খাচার মধ্যে কাউকে বন্ধ করে রাখলে আমরা ভালবাসা পাই না বরং সেই সম্পর্কের খাচা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীতে আমাদের ঘর বাধলে আমরা সুখে থাকব।
     পাখিরা যেমন দিনের বেলায় খাবারের সন্ধানে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় আবার তাদের বাসায় ফিরে আসে তেমনি সম্পর্কে দুজন সারাদিন নিজের স্বাধীনমত থাকলেও সন্ধ্যায় তারা নিজে নিজেদের কাছেই ফিরে আসে।
     অন্যের কাছ থেকে চেয়ে আমরা তার কাছ থেকে নিজেদেরকে অনেক দূর করে নেই। কাউর কাছে কিছু চাইবার পর যখন তা পাই তখন আমরা তার কাছে ঋণি হয়ে যাই। সেই ঋন শোধ না করে তার কাছে আরও অনেক জিনিস চাইতে চাইতে শেষে সে আর দিতে চাই না। মনে কর, তোমার প্রতিবেশী একদিন এসে বলল, “আমার ঘরে চিনি শেষ হয়ে গেছে একটু চিনি দেবেন”। তবে তোমার স্বভাবের সুযোগ নিয়ে সে যদি প্রতিদিন কিছু কিছু জিনিস চাইতে থাকে তাহলে একদিন তুমি তাকে মানা করে দেবে।
     কাউর কাছে কিছু চাওয়ার বদলে আমরা যদি দেওয়া-নেওয়ার মূল্যকে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে ভালবাসাকে আরও ভালভাবে চিনতে পারব। আমরা কাউর কাছ থেকে কিছু পেলে তার বিনিময়ে আমাদেরকেও তাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। আমাদের যেন কখনো এই মানসিকতা না জন্মায় যে কাউর উপর বা কাউর কোন জিনিসের উপর আমাদের অধিকার আছে। আমরা যদি মনে করি কোন কিছু দেওয়ার বিনিময়ে আমরা কিছুই ফিরিয়ে দেব না, কারন সেই জিনিসে আমাদের অধিকার আছে তাহলে আমাদের জীবনও সেইভাবে গড়ে উঠবে যেখানে কিছুই থাকবে না।
     চাওয়া জিনিষটি যে কত খারাপ তা আমরা কখনো বুঝি না। আমাদের যা দরকার বা প্রয়োজন তা আমরা আর একজনের কাছে না চেয়ে সহজেই পেতে পারি, যদি আমরা আর একজনকে স্বাধীনতা দেই। যেমন আমি খেতে বসেছি এবং আমার গ্লাসে জল শেষ তখন মা আমার গ্লাসে জল ঢেলে দেবে। তবে আমার সুখের জন্য আরও কিছু রান্না করতে সে যদি রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকে তবে সে আমাকে দেখতে পাবে না। তখন জলের জন্য তাকে ডাক দিতে হবে বা নিজে সে কাজ করতে হবে।
“যে চায় তার দুঃখ, যে দেয় তার ক্ষমতা, যে পায় তার ভাগ্য”।

     তাহলে কিছু না চেয়ে যদি আমরা কিছু পাই তখন আমাদের সেই ভাগ্যকে আমরা কেন নষ্ট করব।
     আমি একজন লেখকের কাছ থেকে শুনে ছিলাম, অন্যের জন্য লিখ না বরং নিজের জন্য লেখ। কথাটা শুনে আমি বিশ্বাস করেনি কারন আমি যাই লিখি না কেন সবসময় তা অন্যের জন্যে। আমি মনে করি লেখকের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আর একজনকে সুখী করা। যে কারনে তারা তার লেখা পড়ে সেই আসাকে পুরন করা।
    তবে একবার ভেবে দেখা যাক লেখক যাই লেখে প্রথমে তা কার জন্যে? তা কী অন্যের জন্যে? না, বরং সেই লেখকের জন্যে তার লেখা প্রথমে সে অনুভব করে, তারপর তো পাঠক তার ক্ষমতা অনুসারে বোঝে। লেখক তার লেখায় যে জায়গার কথা বলে প্রথমে সে সেই জায়গায় যায়। লেখক যে কথা লেখে প্রথমে সে সেই কথা শোনে, লেখক তার লেখা নিয়ে যা অনুভব করে পরে তা পাঠকের কাছে গিয়ে পৌচ্ছায়। তাহলে আমার যদি লিখতে ভালোলাগে তবে কার জন্য লিখব নিজের জন্যই। কারন সবার আগে আমি তাকে অনুভব করব।
    ঠিক তেমনি আমরা কার জন্য ভালবাসি অন্যের জন্য নাকি নিজের জন্য। আমরা কাউকে ভালোবাসলে তার ভালোলাগবে বলে আমরা তাকে ভালবাসি, নাকি ভালোবাসাকে অনুভব করতে আমরা ভালবাসি। আমরা ভালবাসি আমাদের নিজের জন্য। আমাদের জন্যই আমরা কাউকে ভালবাসতে চাই। অন্যের জন্য নয় বা অন্যেরা আমাদের ভালবাসতে প্রেরণ করে না।
    যারা মনে করে আমরা অন্যের জন্যে ভালবাসি তারা অন্যের আগে নিজে সেই ভালোবাসকে পায়। আমরা অন্যকে ভালবাসার মাধ্যমে নিজেকে ভালবাসি এবং অন্যকে ঘৃনা করে নিজেকে ঘৃনা করি। ভালবাসার অর্থ অন্যকে সেবা করা না, বরং শুধু নিজের অন্তরাত্মার পূজা করা।
    আমরা  কোন কাজ করি ভাবি অন্যের জন্য করছি, তা ভালবাসা হোক, অপমান হোক, হিংসা হোক। আমরা ভাবি কাউকে আপমান করে আমরা তাকে ছোট করছি, কাউকে হিংসা করে তার ক্ষতি করছি। কিন্তু বাস্তবে কাউকে অপমান করলে আমরা প্রথমে নিজের মনের মধ্যে অপমানবোধ করি এবং পরে আবার অপরাধবোধ হয়। কাউকে হিংসা করলে প্রথমে নিজের মানসিক শান্তি হারিয়ে যায় এবং পরে দুচিন্তায় ভুগি। যাকে হিংসা করছি তাতে তার কোন ক্ষতি হয় না, যদি না সে আমার হিংসা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
    এইভাবে কাউকে খুশি করার জন্য আমরা হাপিয়ে যাই, কাউকে ভালবাসার জন্য কষ্ট করতে করতে আমাদের মনে ভালবাসা শেষ হয়ে যায়। তখন নিজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে, আমি এত কিছু করা সত্বেও কেউ আমার সাথে সুখী নয়। তার আত্মসম্মান বোধ হারিয়ে গেলে সে আর কেউকে ভালবাসতে পারে না। কারন সেই মানুষ তখন তার নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে। তারপর শুরু হয় একে অন্যকে দোষ দেওয়া, “আমি এত কিছু করা সত্বেও তুমি সুখী নও, আর কত কিছু চাও”। যদি সেই ভালোবাসাকে প্রথমে আমাদের গায়ে না লাগিয়ে তাকে দিতে চাই তবে তা তার গায়েও লাগবে না। নদীর এপারের হওয়া যদি আমাকে না ছুয়ে তাকে গিয়ে ছোয় তবে সে কখনো বুঝবে না সেই হওয়া কার থেকে এসেছিল।
    কোন কাজ করার পেছনে যদি আমরা নিজের সুখ না খুজী বা সুখ না দেখি তবে সেই কাজ আমরা বারবার করি না। কাউকে ভালবাসতে আমাদের ভালোলাগে বলে আমরা তাকে আবার ভালোবাসতে পারি। তবে যেখানে আমরা কিছুই পাই না, সেই কাজ আমরা করি না।
    আমরা যদি চাই কেউ আমাদেরকে সারাজীবন ভালবাসুক তবে এই একটি কথাই আমাদের বোঝা দরকার যে সে তখনি আমাকে ভালবাসতে পারবে যখন সে স্বাধীনতা পাবে। আমাদের সুখী করার চেষ্ঠা তার মন থেকে ভালবাসা মুছে দিতে পারে যদি সে সেইসব কাজ জোর করে করে। সে যদি আমাদের ভালবাসে তবে আমাদের সমস্ত আসা সে নিজের ইচ্ছায় পূর্ণ করবে। সুখী ও সুন্দর বিবাহিত জীবনে দুজনের ভেতর এই একটি জিনিসই কাজ করে। তারা দুজন নিজের ইচ্ছায় একে অপরের জন্য কাজ করে, কোন কাজে পরস্পরকে জোর করে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন