সূর্য আকাশের শেষ কোনে লাল হয়ে জ্বলছে, টিমটিম করা কোন প্রদীপের মত তার আলো আকাশে সুমুদ্রের কোন থেকে বিদায় নিচ্ছে। পুরীর সুমুদ্রের জল আজ যেন একটু শান্ত, দূর থেকে ওঠা ঢেউ গুলি যেন খুব শান্ত হয়ে তীরের দিকে আসছে। বাতাসে শুধু ঢেউ এর শব্দ আর সুমুদ্রতীরের একটি শান্ত ও শীতল অনুভুতি। কয়েকজন নব দম্পতি যারা পুরী ঘুরতে এসেছে তাদের কয়েকজনকে সুমুদ্রের ধারে দেখা যাচ্ছে। একদিকে এক বিশাল সুমুদ্র চলে গেছে আর একদিকে ঘনবসতি পূর্ণ হোটেল, রেস্তরা, বাড়িঘরগুলি দেখে যেন মনে হচ্ছে এই সুমুদ্রকুল দুটি দুই রকম পৃথিবীর মাঝখানের একটি সীমারেখা।
একটি পৃথিবী যেখানে সাগরের সুর, জলের শীতল ছোয়া, শান্তির পরশ আর একটি পৃথিবী যেখানে কোলাহল, বেচে থাকার যুদ্ধ, যেখানে নিত্যই প্রতিযোগিতার অশেষ দৌড়। এমনই একটি পৃথিবী আমাদের থাকার জায়গা। এই কমক্রিটের পৃথিবীতে বাস করে বোধ হয় আমাদের মনও বালি আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরী হয়ে উঠেছে। যেখানে আর ভালবাসার জায়গা থাকছে না, যেখানে অনুভবের জায়গা থাকছে না। যেখানে টাকা পয়সা দ্বারা গঠিত আমাদের বাইরের রূপটাই সব, আমাদের ভেতরের জায়গাটা ছোট হয়ে এসেছে। এই কমক্রিটের পৃথিবীর সাথে এই সাগরের তুলনা করে মানব তার জীবনকে খুব ক্ষুদ্র বলে মনে করল।
একটি পৃথিবী যেখানে সাগরের সুর, জলের শীতল ছোয়া, শান্তির পরশ আর একটি পৃথিবী যেখানে কোলাহল, বেচে থাকার যুদ্ধ, যেখানে নিত্যই প্রতিযোগিতার অশেষ দৌড়। এমনই একটি পৃথিবী আমাদের থাকার জায়গা। এই কমক্রিটের পৃথিবীতে বাস করে বোধ হয় আমাদের মনও বালি আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরী হয়ে উঠেছে। যেখানে আর ভালবাসার জায়গা থাকছে না, যেখানে অনুভবের জায়গা থাকছে না। যেখানে টাকা পয়সা দ্বারা গঠিত আমাদের বাইরের রূপটাই সব, আমাদের ভেতরের জায়গাটা ছোট হয়ে এসেছে। এই কমক্রিটের পৃথিবীর সাথে এই সাগরের তুলনা করে মানব তার জীবনকে খুব ক্ষুদ্র বলে মনে করল।
‘মানব বন্দোপাধ্যায়’ কলকাতার একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। তার পিতার মৃত্যুর পর সে খুব একা হয়ে পরে এবং তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে তার পিতার ব্যবসা সামলাতে শুরু করে। তার জীবনে সবকিছু থাকা সত্বেও সে কখনো তার জীবনে সুখী হতে পারত না, সবসময় একটা জিনিস তার মনের ভেতর বিধছিল, যে সে এই পৃথিবীতে একা, তার সুখ ভাগ করে নেবার মত কেউ তার কাছে ছিল না। যে সকল ব্যবসাহিক বন্দু ছিল তার শুধু তার ব্যাবসা পর্যন্তই সীমিত ছিল।
মানব তারপর বিবাহ করবে বলে স্থির করে। নানান বনেদী পরিবার থেকে তার জন্য সন্মন্ধ আসত। তবে তার সাথে কোন রকম সম্পর্কই তৈরী হয় নি। বনেদী পরিবারের একমাত্র একা ছেলের নামে যে সন্মন্ধ আসত সেগুলি যতখানি নয় ভালবাসার কারনে তার চেয়ে সেই পাত্রী পরিবারের সাথে তার ব্যবসাহিক সাফল্যে। কোন দুষ্প্রাপ্র পাথরের মত সকলে তাকে দেখত যেন সেই ছেলেটি হাতে পেলে কেউ কোন রত্ন পেয়ে যাবে, যাতে করে সেই পরিবার ও তাদের ব্যবসার উন্নতি ঘটবে। তবে মানব কোন রত্ন হতে চাইত না, সে তার জীবনে কোন রত্ন খুঁজে পেতে চাইত। মাস দশেক দেখা-দেখি চলল তারপর মানব এ সবকিছুতে আর বিশ্বাস করল না। সে দেখা-শোনার কাজ বন্দ করে আবার ব্যবসার দিকে মন দিল। তার মানসিক অবসাদ কাটাতে কিছুদিন কাজ করার পরে সে পুরীতে ঘুরতে আসল।
ব্যবসা থেকে একটু সময় বার করে সে পুরীর সুমুদ্রে তার মনে একটু শান্তির জন্য এসেছিল। কলকাতার জনবহুল লোকসমাজের দুরে সুমুদ্রের নিকট এসে অনেকদিন পরে সে যেন আবার শীতলতার ছোয়া পেল। যে শীতলতা গ্রীষ্মের দুপুরে বটতলায় কোন পথিককে শান্তি দেয়, যে শীতলতা যুদ্ধের থেকে ফিরে কোন যোদ্ধা তার মায়ের কোলে পায়। ঠিক এমনি রকম শান্তির ছোয়া লেগেছিল তার গায়ে। যতই বনেদী পরিবারের ছেলে হোক না কেন পুরীর সুমুদ্রের সাথে তার এই প্রথম পরিচয়। এই সুমুদ্র তার কছে তার মার মত শীতল আচলের ছায়া নিয়ে এসেছিল। যেন সুমুদ্র তার মা আর সেই সুমুদ্রের তীরের কাছে এসে সে তার মায়ের কাছে এসে পৌচ্ছেছে।
জীবনের মাত্র বেশ কয়েকটি দিন মানবের তার মার সাথে কেটেছিল। সাত বছর বয়সে সে তার মা কে হারায় এবং বাকি বয়সটা তার বোর্ডিং স্কুলে কাটে। তার ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য তার পিতা তাকে বোর্ডিং স্কুল পাঠিয়ে দেবাই উচিত ভেবেছিল। আজ এই সুমুদ্রের কাছে এসে তার ছোটবেলার দিনগুলি তার কাছে আবার তাজা হয়ে উঠল। সে সুমুদ্রতীরে বসে দূর থেকে ওঠা ঢেউগুলির দিকে তাকিয়ে তার জীবনের কথা ভাবছিল।
সন্ধ্যা হতে চলেছে আর একটু বাদে সূর্যের আলো সম্পুন্ন নিভে যাবে, আকাশে ফুটবে তারা আর চাদের আলো সূর্যের কাজ করবে। জীবনে পিতার উপহার বলতে তার টাকা পয়সা এবং মাতার উপহার বলতে শুধু তার স্মৃতি। মার কাছ থেকে আর যে একটি উপহার নেওয়া তার বাকি ছিল সেটি সে হয়ত সুমুদ্র তীরে বসে তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে চাইছিল। সে হয়ত তার মার কাছ থেকে তার রুক্ষ, শুস্ক জীবনে শ্রবন নিয়ে আসতে চাইছিল। সে সুমুদ্রের কাছে বসে বিধাতার কী ইচ্ছা জানতে চাইছিল। সে চাইত যদি রূপকথার মত কেউ তার কাছে এসে তার জীবনসঙ্গীর পরিচয় দিয়ে যায়, তার নাম বলে যায়, তার ছবি দেখিয়ে যায়। আজ সুমুদ্রের কাছে বসে বিধাতা হয় তাকে তার সাথে পরিচয় করে দেবে অথবা আজই সে নিজে এই সুমুদ্রমায়ের হাত ধরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে। ঠিক এমনি একটি ইচ্ছা সে করল ও সেখানেই বসে রইল।
সুমুদ্র তো আর কথা বলে না আর রূপকথার কোন গল্পও সত্যি হয় না। মানব বহুক্ষন পারে বসে রইল তখন সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে কোন মেঘ নেই আর তারাগুলি মিটমিট করে জ্বলছে, কুমড়োর ফালির মত একটি চাদ সারা আকাশে শোভা দান করেছে। চাদের আলো যেন সূর্যের আলোর মতই উজ্বল, যার দ্বারা রাতের পরিবেশ পুরো দেখা যাচ্ছে। এমনি এক সুন্দর রাতে মানব একা ফিরে যেতে চাইত না, সে সুমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেল এবং দৃঢ়প্রতিঙ্গ হল আজ বিধাতার ইচ্ছা ও তার ভেতর যেকোনে একজনই বেচে থাকবে।
চাদের আলো আর তারাদের এই পৃথিবীতে কোন মায়ের সন্তানকেই হয়ত বিধাতা ফিরিয়ে দিতে চাইত না। সেই বিধাতার ইচ্ছা যদি মানবকে তার সঙ্গীর সাথে দেখা করাতে না চায় তবে কোন উপায়ে যেন সে তার কাছে তার পরিচয় দিয়ে যায়।
একটি ঢেউ মানবের পায়ে এসে পড়ল, মানবের মনে হল যেন কোন সামুদ্রিক প্রাণী তার পা জড়িয়ে ধরেছে। ঢেউটি ফিরে গেলে সে দেখল তার পায়ের কাছে একটি জিনিস চাদের আলোয় চকমক করছে। সে সেটিকে হাতে নিয়ে দেখল একটি নুপুর। সে ভাবল বিধাতাই হয়ত সেই মেয়েটির নুপুর তার কাছে এনে দিয়েছে। সে এই নুপুরের আর একটি সন্ধান করে তার সাথে তার জীবন কাটাবে, যাকে বিধাতা তার কাছে এনে দিয়েছে।
( ২ )
“ ‘মন’ তুমি যাবে না, এখানে এসে যদি এই সুমুদ্রের জলে ভিজতেই না পারলাম তাহলে তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলে কেন ?” ‘মন’ তবুও বসে রইল বলল, “পুরিতে দেখার ও ঘরবার আরও জায়গা আছে, আমরা চল সেখানে যাই, তুমি কেন সুমুদ্রের কাছে যেতে চাইছ। আবহাওয়া ভালো নয়, এই সময় সুমুদ্রের ধরে যাওয়া নিরাপদ হবে না। চলো আমি তমাকে অন্য কথাও ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছি।” আবহাওয়া সে ‘মনে’র সুমুদ্রের ধারে না যাবার কারন নয় সে কথা ‘মহুয়া ‘ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল। সুমুদ্রের ধরে যাবার অসম্মতির কারন ‘মহুয়া’ জানত না, তবে মনের দিকে তাকিয়ে সে চুপ করে গেল।
‘মানব বন্দোপাধ্যায়’ এখন বিবাহিত, তাকে তার স্ত্রী ‘মন’বলে ডাকে। তারা বিয়ের পর প্রথমবার এখানে বেড়াতে এসেছে। ‘মন’ পুরীতে আসতে চাইনি কারন এই জায়গা সম্পর্কে তার স্মৃতি তাকে কষ্ট দিত।
মানব তার স্ত্রী মহুয়াকে পুরীর অন্যান্য জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেল। শহরের কয়েকটি বড় মন্দির ঘুরবার পর একটি পাচ তারা হোটেলে ‘লাঞ্চ’ তারপর একটি থিয়েটার, স্মৃতিসৌধ , সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে সেই সবকিছুর মধ্যে মহুয়া অলস হয়ে ছিল, ‘মনের’ কাছে তার অবস্হা আর লুকানো থাকল না। যখন বিকাল হতে যায় তারা তাদের হোটেলে ফিরে এলো।
দুজনে থাকবার জন্য মন যে ঘরটি বুক করেছিল সেটি ছিল সুমুদ্রের বেশ কাছে। ঘর থেকে সুমুদ্রে ওঠা প্রতিটি ঢেউ এর শব্দ শোনা যায়। ব্যালকনিতে এসে দাড়ালে সুমুদ্রের ওই দৃশ্য চোখের সামনে পরিষ্কার ভেসে ওঠে। দুজনে থাকবার জন্য একটি বেড, ওয়াশরুম ও ঘরের প্রয়োজনিয় সমস্ত জিনিস সেই ঘরে ছিল।
ঘরে এসে মহুয়া ওয়াশরুমে গেল এবং মন চেয়ারে বসে বিশ্রাম করছিল। দুরের সুমুদ্র থেকে ওঠা প্রতিটি ঢেউ এর শব্দ শুনে মানব চোখ বন্দ করে প্রতিটি ভেউকে নিজের বুকের ভেতর অনুভব করছে। তার মন অবাধে সেই সুমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে, তার মনের উপর তার কোন আয়ত্ব নেই, সে তার মনের স্বরূপ দর্শনে ব্যালকনির সামনে এসে দাড়াল। সে সেই সুমুদ্রের প্রতি চেয়ে থাকল এবং ভাবল এই সুমুদ্রই প্রথম একদিন সপ্ন দেখিয়েছিল, এই সুমুদ্রের কাছে এসেই সে অজানা অচেনা কাউকে ভালবেসেছিল। এই সুমুদ্রকে সে তার মা বলে ডেকেছিল, এই সুমুদ্রের পাশেই সে তার প্রিয়তমার নুপুর খুঁজে পেয়েছিল। সেইসব কথা এখন যেন শুধু তার কল্পকথা বলেই মনে হল। সেইসব কথা সেই একটি ছোট বয়সের ছেলের ছেলেমানসী। ‘মন’ ব্যালকনির সামনে কাঠের মূর্তি হয়েই দাড়িয়ে থাকল। হঠাত্ আওয়াজ এল -- “‘মন’ আমার কাপড়টা দাও না ! ” ‘মন’ হুস ফিরে পেয়ে সে ঘরে এসে বিছানার নিচের ব্যাগ থেকে একটি কাপড় বার করে মহুয়াকে দিয়ে দিল, মহুয়া দরজা থেকে হাত বার করে তার কাপড় নিয়ে সে দরজা বন্দ করে দিল।\
‘মন’ বিছানার নিচে থেকে ব্যাগটা বিছানার উপরে তুলে ব্যাগের চেন আটকে দিতে গিয়ে দেখল ব্যাগের পাশের একটি ছোট জায়গায় কি একটা যেন ছনছন করছে। ব্যাগের পাশের সেই চেনটা খুলে দেখল সেখানে একটি নুপুর। ‘মন’ বুঝতে পারল এটি সম্ভবত মহুয়ার নুপুর, সে স্নান করতে যাবার আগে এখানে রেখে দিয়ে গেছে। মহুয়ার পায়ের সেই নুপুরটি মানবকে সুমুদ্রের পারে পাওয়া আর একটি নুপুরের কথা মনে করিয়ে দিল। মানব যখন আগে পুরিতে এসেছিল ঠিক এমনি একটি নুপুর খুঁজে পেয়েছিল যা সে আজও খুব যত্ন করে তার কছে গুছিয়ে রেখেদেছে। মানব ডায়রি লেখে, সে তার ডায়রি কাউকে দেখতে দেয় না, যে খানেই যায় না কেন তার ডায়রি সে সবসময় তার সাথে রাখে। আজও সে এখানে তার ডায়রি নিয়ে এসেছে, সে তার ব্যাগ থেকে তার ডায়রিটা বার করে তার ভেতর থেকে সেই নুপূরটি বার করল।সেত এখনো তার কাছে নতুন হয়ে আছে, ডায়রির ভেতরে থেকে ডায়রির উপরে দাগ হয়ে গেছে তবে নুপূরটি কোন ভাবে নোংরা হয়নি। ‘মন’ সেই নুপুরটিকে আনেকদিন ধরে সবার চোখের আড়াল করে তার কাছে লুকিয়ে রেখেছিল। আজ সে নুপুরটিকে বার করে হাতে নিয়ে তার দিকে রইল। ঠিক এইসময় ওয়াসরুমের দরজার শব্দ হল, মানব জবুথবু হয়ে নুপুরটিকে তার ডায়রির ভেতর ঢুকিয়ে তার ব্যাগের ভেতর পুরে দিল। মহুয়া ওয়াসরাম থেকে বেরিয়ে তার ভেজা চুলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে মানবকে জিজ্ঞাসা করল, “‘মন’ তুমি কী করছ” ? মানব বলল , “ কিছু না।”
( ৩ )
বিকাল হল সূর্যের আলো হেলে পরেছে, ব্যালকনীর পর্দার আড়াল থেকে সূর্যের আলো মানবের মুখে বারে বারে এসে পরছে। হওয়ার পর্দা উড়ে গিয়ে বারে বারে সূর্যের আলো মানবের চখে এসে পরছে ও সুমুদ্রের হওয়া মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর এত ঝর তুলছে যেন সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবার মত।
পাচ তার হোটেল থেকে ঘুরে আসার পর মানব ও মহুয়া তাদের ভাড়া করা হোটেলের ঘরে এসে বিশ্রাম করছিল। পুরী সম্পর্কে মহুয়ার সবচেয়ে বর আকর্ষন ছিল এই সুমুদ্র, সে এই সুমুদ্র দেখতে চাইত। তবে মানবের অসম্মতিতে মহুয়া সেখানে আর যেতে পারেনি। শহর ঘুরবার সময় সে সেসব কোন কিছুকেই অনুভব করেনি , কোনকিছুকে না পাবার শোক সবসময় তার মনের ভেতর চেপে রেখেছিল। হোটেলে ফিরে আসার পর সে খুব চুপ চাপ ছিল।
মানবের চোখের ওপর রোদ এসে মানবের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। মানব ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনির সামনের দরজাটা বন্দ করে যখন তার বিছানার দিকে তাকাল, দেখল মহুয়া সেখানে নেই। ওয়াশরুমের দরজাও বাইরে থেকে আটকানো আছে। মানব ভাবল, তাকে জিজ্ঞাসা না করে মহুয়া কথাও যায় না। মানব গায়ে একটা জামা পরে ঘর থেকে বিরিয়ে তাকে খুজতে বেরল, রিসেপশন, ইনক্রারী সেকশনে জিজ্ঞাসা করায় কেউ মহুয়াকে চিনতে পেল না। মানব হোটেলের বাইরে আসল মহুয়াকে খোজার জন্য, তবে হোটেলে ও হোটেলের চারপাশে কথাও তাকে দেখতে পেল না।
মানব যেন একটু অস্হির হয়ে উঠল। মহুয়া তার মোবাইল ফোনটিকেও হোটেলের ঘরে ফেলে রেখে গেছে। মানব ভাবল মহুয়া তো কোন ছেলে মানুষ নয় যে হারিয়ে যাবে, তবে সে এই সময় কোথায় গেছে। মানব হোটেলের সামনে একটি পার্কে চুপ করে বসে রইল।
“বাবা আমি ওখানে যাব”, কোথায় , “ঐ সুমুদ্রের ধরে”, এখন ? “হ্যা”। মানবের সামনে একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে তার বাবার সাথে সুমুদ্রের ধরে যাবার জন্য বায়না করছে। তাদের দেখে মানবের মহুয়ার কথা মনে পড়ল যে আজ সকালে মহুয়াও ঠিক এমনি রকম বায়না করছিল। তবে মানব তাকে সুমুদ্রের ধরে যেতে দেয়নি বরং আবহাওয়া ভালো না থাকার অজুহাত দিয়েছে।
মানব পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে সুমুদ্রের দিকে সেই বাবা ও তার মেয়ের পিছন পিছন গেল। মানবের মনে হয়েছে মহুয়া বোধ হয় সুমুদ্রের কাছে গেছে। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মানব দেখল মহুয়া একজায়গায় দাড়িয়ে সুমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মানব মহুয়ার কাছে এসে তার কাধে হাত দিল, মহুয়া ঘুরে মানবের দিকে তাকাল। মানব তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এখানে দাড়িয়ে আছ কেন ? আমি তোমাকে কত জায়গায় খুজছিলাম, কাউকে কিছু না বলে এভাবে কথাও যেতে আছে ? তুমি কী যান না তোমার জন্য কেউ চিন্তা করবে” ? মহুয়া বলল, “‘সরি’ ভুল হয়ে গেছে, আমি আর এমন করব না”।এই বলে মহুয়া মানবের হাত ধরে তাদের হোটেলের দিকে যেতে চাইল। তার দুজন আবার যখন হোটেলে ফিরে আসছিল, মানব মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল সে এখনে এসে সুখী নয়। তার মুখে তার মনের কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার মন ভালো নেই। মানব কখনো মহুয়াকে এভাবে দেখতে চায় না, মানব খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারল তার মন ভালো না থাকার কারন। বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে এসে মানব তার মহুয়াকে এই উপহার দিতে চাইত না।
হোটেলের কাছাকাছি এসে মানব দাড়িয়ে পরল। মহুয়া জিজ্ঞাসা করল , “কী হয়েছে ? দিড়িয়ে গেলে কেন” ? মানব কোন কথা না বলে তার হাত ধরে আবার থাকে সুমুদ্রের দিকে নিয়ে গেল। মহুয়া জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কোথায় যাচ্ছ”, মানব বলল, “চলো না”।
তারা দুইজন সুমুদ্রের কাছে এসে দাড়াল। মানব দেখল , সেই ছোট্ট মেয়েটি যে তার বাবার সাথে সুমুদ্রের কাছে আসতে চাইছিল সে সেখনে মাটি নিয়ে খেলা করছে, তার জামা কাপড়ে কাদা লাগাচ্ছে, আর তার বাবা তার মত ছোট হয়ে তার সাথে খেলা করছে। মানব মহুয়াকে বলল, “দেখছ মহুয়া ওদেরকে, ঐ বাবা আর মেয়েকে। আমি যখন হোটেলে ছিলাম দেখছিলাম ঐ বাচ্ছা মেয়েটি সুমুদ্রের ধরে যাবার জন্য তার বাবার কাছে বায়না করছিল। তার বাবা তাই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, তার সাথে খেলা করছে, জামা-কাপড়ে কাদা মাটি লাগাচ্ছে। জামা-কাপড় নোংরা করার জন্য হয়ত ঘরে গিয়ে সে তার মার কাছে বকা খাবে এবং তার পিতাও অনেক কথা শুনবে। সেই পিতা সেই সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে শুধু তার মেয়ের খুশির জন্য। তবে আমি কি তোমার জন্য একটু মানিয়ে নিতে পারি না” ? মানব বলল, “আমি জানি তুমিও সুমুদ্রের ধারে যেতে চাইছিলে, তবে আমি তোমার কোন কথা শোনেনি। যখন আমার শহর ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম তখন তোমার মন ভালো ছিল না, হোটেলে ফিরে এসেও তুমি ভালো থাকতে পারোনি। তাই এখন তুমি সুমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলে। তবে এখন আর তোমার মনকে বেধে রেখ না সে যেখানে যেতে চায় তাকে সেখান যেতে দাও”।
মানব ও মহুয়া দুজনে সুমুদ্রের সামনে এসে বসল, মাঝে মাঝে কয়েকটি বর ঢেউ এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেই ছোট্ট মেয়ে ও তার বাবা সুমুদ্রের জলে গা হাত পা ধুয়ে তারা তাদের হোটেলের দিকে ফিরে গেল। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, সুমুদ্রের তীরে বেশি লোক নেই, দু একটি লোকের দুরে দেখা যাচ্ছে। শান্ত নিলিবিলি জায়গায় বসে তারা দুজন তাদের মনের কথা বলছে, যেন সেই সুমুদের সাক্ষী রেখে তারা দুজন মন থেকে পরস্পরকে আরও ভালো করে চিনছে।
মনব বলল, “মহুয়া জান , এই সুমুদ্রের সাথে আমার একটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে, আমি ছোটবেলায় আমার মাকে হারিয়েছি, বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকত। তাই মা মারা যাবার পর আমি বোর্ডিং স্কুলে মানুষ হই। আমার পড়াশুনা শেষ করার পর বাবাও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আর আমার জন্য তার ব্যবসা ও সম্পত্তি রেখে যায়। আমার ছোটবেলার কোন দিনই আমি আমার বাবার সাথে খেলা করেনি। আমার ছোটবেলার দিনগুলিতে নিজের বলতে আমি শুধু নিজেই ছিলাম। বাবার ব্যবসা আমার হাতে আসার পর আমি কয়েকটি মুহূর্ত নিজেকে শান্তি দিতে পুরীতে ঘুরতে এসেছিলাম। তখন ঠিক এমনি একটি দিনে সুমুদ্রের ধরে আমি একাএকা আমি বসেছিলাম”।
মহুয়া মানবের দিকে তাকিয়ে আছে, সে বলল, “তারপর কী” ?
মানব। “আমি এখানে এসে খুব শান্তি পেয়েছিলাম, সুমুদ্রের প্রতিটি ভেউ যেন আমার বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।আমি সেই শান্তি শুধু আমার মায়ের কোলেই অনুভব করতাম। সেইদিন সুমুদ্র আমার কাছে আমার মা হয়ে এসেছিল। সন্তান যতই ক্লান্ত হোক না কেন তার মার কোল যেমন তার কাছে শীতল ছায়া তেমনি আমার জীবনে এই প্রথমবার এই সুমুদ্র আমার মাথার ওপর ছায়া করে আমাকে জীবনের দুঃখ, যন্ত্রনা ও ক্লান্তি থেকে বাচিয়ে ছিল”।
মহুয়া বলল, “তোমার সুমুদ্রের কাছে আসতে এত ভালোলাগে তবে তুমি কেন এখানে আসতে চাওনি”।
মানব বলল, “আমি আমার জীবনে একা বেচে থাকার যন্ত্রনা সবসময় অনুভব করেছি, কিন্তু সেই দিন মার ভালোবাসাকে এই সুমুদ্রের কাছে অনুভব করে আমি আর একা থাকতে চাইনি। আমি বিধাতার কাছে বলেছিলাম আজকে তুমি আমাকে আমার জীবন সঙ্গীর সাথে পরিচয় করে দাও তা না হলে এই সুমুদ্রে আমি ডুব দিয়ে মার সাথেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব”।
মহুয়া। “তারপর”।
মানব। “যখন আমি মরবার জন্য সুমুদ্রের দিকে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছি, ঠিক তখনি একটি ঢেউ এসে আমার পায়ের উপর একটি জিনিস এসে পরল। আমি সেটি হাতে নিয়ে দেখলাম সেটি একটি নুপুর। আমি ভেবেছিলাম বিধাতা হয়ত বলতে চেয়েছিল যে এই নুপূর্তি যার পায়ের সেই তোমার জীবনসঙ্গিনী। সেইদিন থেকে আমি সেই অজানা মেয়েটিকে ভালবাসি, সেই নুপুরটি আজও আমি গুছিয়ে রেখেছি, তবে অনেক চেষ্টা করার পরেও আমি সেই নুপুরের আর এক জোড়া আমি খুঁজে পায়নি। তাই তোমার এই সুমুদ্র আমার আঘাত করেছে, বিশ্বাস রাখেনি, তাই আমি কখনো সুমুদ্রের কাছে আসতে চাইনি”। মহুয়ার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সে চুপ করে রইল, কোন কথা বলল না। মানব সুমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।মহুয়া চোখের জল মুছে মানবের দিকে তাকাল। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সূর্য বিদায় দিয়ে আকাশে অনেক তারা ফুটিয়ে দিয়েছে এবং পূর্নিমার চাদের আলোতে তারা তাদের মুখ দেখছে।
( ৪ )
সন্ধ্যার পর তারা তাদের হোটেলে ফিরে এল। ব্যালকনির সামনে দাড়িয়ে মহুয়া মানবের মুখের কথাগুলি ভাবছিল। যদি মানব সেই অচেনা অজানা কাউকে ভালবাসে তবে সে কেন তাকে বিয়ে করেছে। মানবের জন্য হয়ত সে নয় , মানবের ভাগ্য বিধাতা হয়ত অন্য কাউর সাথে লিখেছিল। মানবের জীবনে মহুয়া হয়ত ভুলবসত চলে এসেছে। মহুয়া সে সবকথা চিন্তা করতে থাকল এবং ভাবল মানব সারাজীবন একা থেকে মানুষ হয়েছে তার জন্য বিধাতা যাকে ঠিক করে রেখেছে মানবকে তার কাছেই থাকা উচিত। মহুয়া ভাবল সে যে কোন জায়গা থেকে সেই নুপুরের মেয়েটিকে খুঁজে বার করবে। এই কথা ভেবে সে ব্যালকনি থেকে তাদের ঘরের ভেতর প্রবেশ করল, ইতিমধ্যে মানবও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। মহুয়া মানবকে জিজ্ঞাসা করল, “‘মন’ তুমি ওই নুপুরটিকে কোথায় গুছিয়ে রেখেছ” ? মানব হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তুমি হাত পা ধুয়ে আস এখন আবার ঐসব কেন” ? মানব জোর করায় মহুয়া ওয়াশরুম থেকে ফিরে এল। তবে তার পরেও মানবকে একই কথা জিজ্ঞাসা করল, “‘মন’ঐ নুপুরটি কোথায়” ? অনেকবার প্রশ্ন করার পর চারবারের বার মানব বলল, “আমার ঐ ডায়রির ভেতর সেটি রাখা আছে” ? মহুয়া জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ডায়রি কোথায়” ? ‘মন’ তার ব্যাগ থেকে ডায়রিটা বার করে মহুয়াকে দিয়ে এবং সে ব্যালকনির সামনে এসে দাড়াল।
মহুয়া ডায়রির ভেতর থেকে নুপুরটিকে হাতে নিয়ে তাকে চিনতে পেরেছিল। তার মনে পড়ল একবছর আগে সে যখন পুরীতে এসেছিল, তার পায়ের ঠিক এমনি একটি নুপুর হারিয়ে গিয়েছিল। ‘মন’ তার নুপুরটিকেই খুঁজে পেয়েছে। মহুয়া নুপুরটিকে হাতে নিয়ে গুমরে গুমরে কাদছে। মহুয়ার গলার আওয়াজ শুনে মানব ব্যালকনি থেকে মহুয়ার কাছে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, “‘মহু’ কাদছ কেন ? কী হয়েছে ? বস এখানে বস”। মানব মহুয়াকে বিছানার উপর বসিয়ে তার কাছে হাটু ভাজ করে দাড়াল। “‘সোনা’ কী হয়েছে ? কাদছ কেন ? না, ভালো মেয়ে কাদে না”। মানব কিছুক্ষন পরে তার কান্না থামিয়ে তাকে বলল, “এবার বল কি হয়েছে”। মহুয়া বলল, “ আমি যখন প্রথম এখনে এসেছিলাম আমি এই নুপুরটিকে হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন আমি খুব কেদেছি। এই নুপুরটি আমার জন্মদিনে আমার বাবা আমাকে দিয়েছিল, আজকে তোমার কাছ থেকে তাকে খুঁজে পেয়েছি।
মানব মহুয়াকে কাছে টেনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। রাত শান্ত, বিবাহের পর প্রথম তারা পরস্পরকে আরও নতুন করে কাছে পেল। আকাশে পূর্নিমার চাদ আর ঘরে আর এক ভালবাসার পূর্নিমা তাদের জীবনে তারা অনুভব করল। “তুমিই আমার ভালবাসা ছিলে, তোমাকেই ভালোবেসেছি তবে তোমাকেই চিনতে পারেনি”।