যাকোব (২:১৮)
আমরা যাকে ভালবাসি সে আমাদের বিশ্বাস না করলে তার প্রতি আমাদের ভালবাসা বজায় থাকে না। ধীরে ধীরে তার প্রতি ভালবাসা মলিন হতে থাকে। আমরা কাউকে ভালবাসলে সে যদি আমাদের উপর সহজে বিশ্বাস করতে না পারে, তবে তার জন্য দুঃখ না পেয়ে যদি নিজেদেরকে একটু সময় দেওয়া হয় তাহলে সেই বিশ্বাস গড়ে তোলা যায়। নতুবা কাউর প্রতি বিশ্বাস, ভরসা করলে তার থেকে কিছু ফিরে না পেলে তা আমাদেরকে পরস্পরের থেকে দূর করে দেয়। তাই আমাদের জানার প্রয়োজন বোধ হয় কিভাবে আমরা নিজেদের ভেতর পারস্পরিক বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারি।
কয়দিন আগে আমি আমার দিদির ৬ বছরের ছোট মেয়ের সাথে একটা খেলা করছিলাম। সে সোজাভাবে দাড়িয়ে পিছনে খাড়া ভাবে পড়ে যাবে আর আমি পিছনে থেকে ওকে ধরে নেব। প্রথমে ও খাড়া ভাবে পেছনে পরে যেতে ভয় পাচ্ছিল, ও ভাবছিল ও পড়ে যাবে। আমি ওকে বললাম, ‘তুই চিন্তা করিস না আমি তোকে ঠিক ধরে নেব’। প্রথমে সে তার সাহস পেল না, তাই বার বার পিছন দিকে পা বাড়িয়ে দিচ্ছিল, বার বার আমি ওকে ধরে ফেলছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে ওর মনে যখন বিশ্বাস জাগল শেষে ও নিশ্চিন্তে খাড়া ভাবে পিছনে পড়ছে আর আমি পিছনে থেকে ওকে ধরে ফেলছি।
এই ঘটনা থেকে আমি শিখলাম, আমারদের উপর বিশ্বাস করার জন্য আমরা কাউকে জোর করতে পারি না। তবে আমাদের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে ওঠার জন্য পরস্পরকে সময় দিতে পারি। তাকে দেওয়া প্রতিটি কথার দাম রাখলে সেখানেই আমাদের উপর তার বিশ্বাস গড়ে ওঠে। তাই বড় বড় কথা দিয়ে কাউর বিশ্বাস পাওয়া যায় না, সেই কথা দাম রেখে পাওয়া যায়।
তাই আর একজনের উপর দোষ না দিয়ে নিজেদের ভেতর সেই বিশ্বাসকে গড়ে তোলার চেষ্ঠা কর। নিজে নিজের মত থাক, কাউকে ভালবাসলে তার প্রতি ততটুকু ভালবাসা বজায় রাখ, নিজের ভাল স্বভাবকে চেঞ্জ কর না। তাতে তোমার স্বভাবে যখন তোমার সমস্ত কথা ফুটে উঠবে তখনই তোমার প্রতি তার বিশ্বাস জন্মাবে। জোর করে নিজেদের ভেতর বিশ্বাস জন্মায় না।
“বিশ্বাস করে কাউর হাত ধর একসাথে থাকার সময় তার ভেতর বিশ্বাস খোজার চেষ্টা করো না।”
আমি এর আগে লিখেছিলাম আমাদের স্বভাব কিভাবে আমাদের সহজে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে। কাউকে চিনে তার উপর বিশ্বাস গড়ে তোলার চেয়ে, প্রথমে বিশ্বাস করে সম্পর্ক গড়ে তোল। কারন যে সময়টা আমাদের নিজেদের সাথে কাটানো উচিত সেই সময়টা আমরা শুধু একে অপরকে চিনতে ও জানতেই কাটিয়ে দিই।
আমরা যদি সহজে কাউকে বিশ্বাস না করতে পারি, কাউকে চিনে, জেনে তাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করি তাহলে প্রাথমিক কয়েকটি জিনিস আমাদের মনে রাখা দরকার। যেমন,
১. প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলা।
২. নিজেদের ভেতরের ছোট খাট কথার দাম রাখা।
৩. প্রথমে বন্ধুত্ব করে বিশ্বাস পাওয়ার চেষ্ঠা করা।
৪. কাউর বিশ্বাস পাওয়ার জন্য জোর না করা।
৫. বিশ্বাস গড়ে ওঠার জন্য পরস্পরকে যথেষ্ট সময় দেওয়া।
১. প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলা।
অন্য কেউ আমাদেরকে বিশ্বাস করুক তার আগে আমাদের নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলা দরকার। নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলার অর্থ নিজে নিজেকে দেওয়া কথাগুলির দাম রাখা। নিজে নিজের সাথে করা সংকল্পকে পালন করা। নিজের উপর সেই বিশ্বাস গড়ে উঠলে আমরা জানতে পারি আমরা কতটা কাউর বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম।
দুজনের প্রথমে নিজের উপর সেই বিশ্বাস গড়ে উঠলে তার সঙ্গী তাকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে। কারন সে নিজে নিজেকে দেওয়া কথাগুলির দাম রাখতে পারলে, অন্যকে দেওয়া কথাগুলিরও দাম রাখতে পারে। নিজের যোগ্যতার উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে অন্যের যোগ্যতার উপর বিশ্বাস করে। নিজে নিজের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে অন্যের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক থাকে।
আমি যদি ভাবি আজ থেকে প্রতিদিন সকালে উঠে ব্যায়াম করার জন্যে নিজেকে একটু সময় দেব ও প্রতিদিন সকালে উঠে সেই কথা অনুযায়ী নিজেকে একটু সময় দেই, তাহলে আমি নিজে নিজেকে দেওয়া কথাগুলির দাম রাখি। তাই আমি যদি অন্য কাউকে কোন কথা দেই সেই কথা রাখার ক্ষমতাও আমার ভেতর থাকবে।
তাই অন্য কাউর কাছ থেকে তার বিশ্বাস চাওয়ার আগে প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলা দরকার। নিজেকে দেওয়া কথাগুলির দাম রাখা দরকার, নিজের ক্ষমতার উপর আস্হা রাখা দরকার। তাহলে দুজনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহজে বিশ্বাস গড়ে ওঠে ও পরস্পরের প্রতি ভালবাসা বজায় থাকে।
২. নিজেদের ভেতরের ছোটখাট কথার দাম রাখা।
নিজেদের মধ্যে ধীরে ধীরে বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য নিজেদের ভেতরের ছোটখাট কথার দাম রাখ। কাউকে বড় বড় কথা দিয়ে তার প্রতি আমাদের বিশ্বাস গড়ে ওঠে না, বিশ্বাস গড়ে ওঠে সেই কথা নেভালে। তাই জীবনে শুধু বড় বড় কথাগুলি পালন না করে, ছোট খাট কথাগুলির দিকে মন দাও। প্রতিদিন নিজেদের ভেতরের সেই সমস্ত ছোট খাট কথার দাম রাখতে পারলেই ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে উঠবে। জীবনে বড় বড় কথাগুলি পালন করার কথা বলে তাদের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে ওঠে না।
আমরা ভাবি বিশ্বাস শুধু জীবনের বড় বড় জায়গাগুলিতে একসাথে থাকা। কিন্তু বিশ্বাস লুকিয়ে থাকে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে। বিশ্বাসকে আমরা জীবনে কদাচিৎ অনুভব করি না, কাউর সাথে থাকতে গেলে তার উপর সবসময় বিশ্বাস রাখতে হয়।
যদি তাকে কোন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ও সে তা ভালোভাবে পালন করে তবে তার উপর বিশ্বাস গড়ে ওঠে। যদি সে কাজ করতে ভুলে যায় বা কথা দিয়েও কথা না রাখে তাহলে তার উপর বিশ্বাস ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যদি কেউ পরস্পরের প্রতি সেই সমস্ত ছোটখাট কথাগুলির দাম রাখে তবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে সেই বিশ্বাস গড়ে ওঠে এবং জীবনের বড় বড় জায়গায় সহজে আর একজনকে বিশ্বাস করতে পারে।
৩. প্রথমে বন্ধুত্ব করে বিশ্বাস পাওয়ার চেষ্ঠা করা।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অন্যান্য সম্পর্ক থেকে আলাদা এবং এখানে বিশ্বাসের চাহিদাও অনেক বেশি। তবে এই সম্পর্কে আর একজন আমাদের উপর বিশ্বাস করুক তার জন্য জোর করতে পারি না। তাই স্বামী-স্ত্রী হয়ে বিশ্বাস গড়ে না তুলে প্রথমে বন্ধু হয়ে বিশ্বাস গড়ে তোলার চেষ্টা কর কারন বন্ধুত্ব বিশ্বাস গড়ে তোলায় আরও সহায়ক।
অনেক সময় আমরা আমাদের পরিবারের সাথে কোন কথা শেয়ার করতে না পারলে নিজের বন্ধুর সাথে সেই কথা শেয়ার করি। যদি পরিবারের কোন সদস্য আমাদের কাছে আমাদের বন্ধুর মত হয় তবে তার কাছে সেই কথা শেয়ার করতে চাই।
বিবাহিত জীবনে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে যদি সেই বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায় তবে তারা পরস্পরের সাথে সব কথা শেয়ার করবে এবং পরস্পরের মধ্যে কিছু লুকানো না থাকলে তারা একে অপরকে আরও ভালোভাবে চিনবে ও সাথে সাথে তাদের মধ্যে বিশ্বাসও গড়ে উঠবে।
স্বামী স্ত্রী হয়ে জীবনে বড় বড় জিনিসে বিশ্বাস পাবার চেয়ে বন্ধু হযে ছোট ছোট জিনিসের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলার চেষ্টা কর। তাই দুজনের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলেও প্রথমে বন্ধুত্বের হাত বাড়াও, তারপর তার সহচরী হবার চেষ্টা করবে।
৪. কাউর বিশ্বাস পাওয়ার জন্য জোর না করা।
সততাকে কখনো প্রমান করার প্রয়োজন হয় না কারণ সততা নিজেই তার প্রমান সারাজীবন ধরে দিয়ে যায়। যদি তুমি ভাল হও তোমার সাথে যে থাকবে সে প্রত্যক্ষ তার প্রমান পাবে। তার কাছে তোমাকে কোন কিছু প্রমান করার চেষ্ঠা করতে হবে না। সূর্য যদি পূর্ব দিকে ওঠে তবে প্রতিদিন সকালে প্রত্যক্ষ তার প্রমান পাওয়া যাবে। সূর্য সেই সত্যিকে প্রমান করার চেষ্টা করবে না।
ঠিক তেমনি আমরা যদি ভালো হই ও সবার বিশ্বাস পাবার যোগ্যতা রাখি তাহলে আমাদের কাউর কাছে নিজেদের প্রমান করতে হয় না। শুধু আমাদের নিজেদের স্বভাব সবার প্রতি ভালোভাবে বজায় রাখতে হয়। মানুষ আমদেরকে চিনুক ও আমাদের প্রত্যক্ষ যাচাই করুক তার জন্য সেইসকল মানুষের সাথে নিজেদের সময় দিতে হয়। তাদের সামনে থাকতে হয় তারা আমাদেরকে চেনার জন্য।
তবে মানুষের বিশ্বাস পাবার জন্য তার উপর জোর করতে পারি না, দাবি করতে পারি না কেউ আমাদেরকে বিশ্বাস করুক। সবার সহজে বিশ্বাস করার প্রবনতা থাকে না, তাই তারা প্রথমে চিনে তারপর আর একজনকে বিশ্বাস করতে চায়। তাহলে যদি কেউ তোমাকে চিনতে চায় তাহলে সেই সময়টুকু তুমি তাকে দাও। সে তোমার উপর বিশ্বাস করতে পারে না এই কথা ভেবে যদি তার থেকে নিজেকে দূর করে নাও তাহলে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভবনাকেও দূর করে দেবে।
৫. বিশ্বাস গড়ে ওঠার জন্য পরস্পরকে যথেষ্ট সময় দেওয়া।
পরস্পরের মধ্যে ধীরে ধীরে বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য প্রথম পদক্ষেপের সাথে তার পরবর্তী পদক্ষেপের সুন্দর যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে তোলার পর, নিজেদের ভেতরের ছোট খাট কথার দাম রাখা। বন্ধুত্ব করার পর বিশ্বাস পাবার জন্য জোর না করা ও তারপরে বিশ্বাস গড়ে ওঠার জন্য পরস্পরকে যথেষ্ট সময় দেওয়া।
বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য যদি পরস্পরকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া হয়, অল্প কিছু সময়ের মধ্যে তাদের ভেতর অটুট বিশ্বাস গড়ে ওঠে না। তাই যথাসম্ভব নিজের জীবনের মূল্যবান সময় তার সাথে কাটাবার চেষ্টা কর। পরস্পরকে চেনার চেষ্টা কর যাতে ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে সেই বিশ্বাস গড়ে ওঠে।
অল্প কয়েকদিনের পরিচয়ে কাউর কাছ থেকে বিশ্বাস আসা করা আমাদের মানায় না। যদি তুমি মনে কর তুমি অন্যের কথার দাম রাখতে পার তাহলে তাকে তোমায় চেনার জন্য যথেষ্ট সময় দাও। যদি সে তোমার কাছে খুবই মূল্যবান হয়ে থাকে তবে সে তোমাকে চিনতে যতটা সময় নেয় তাকে ততটা সময় দাও।
যদি তার সাথেই সারাজীবন থাকতে হয় ও তার সাথেই বোঝাপড়া করে চলতে হয় ও যদি সেখানে বিশ্বাসের চাহিদাও খুব প্রয়জন হয় তো সেই বিশ্বাস গড়ে তলার জন্য যদি বেশি সময় দেওয়ার প্রয়োজন হয় তো সেটাই করা উচিত। কয়েকদিন একসাথে থেকে যদি বিশ্বাস গড়ে না ওঠে তাহলে অন্যের সাথে থাকলেও তার উপর সন্দেহ করে আমরা কাউর কোন উপকার করি না।
নিজের সঙ্গীর উপর নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা উজ্বল ব্যক্তিত্বের পরিচয় এবং যদি তা না হয় তবে নিজের সঙ্গীর উপর ধীরে ধীরে বিশ্বাস গড়ে তোলাই আমাদের কাম্য। কাউর উপর ধীরে ধীরে বিশ্বাস গড়ে তোলার আরও অনেক উপায় দম্পতিদের মধ্যে থাকে তবে তাদের মধ্যে প্রাথমিক কয়েকটি উপায় এখানে লেখা হল। এই কয়টি প্রথমিক কয়েকটি উপায় দিয়ে যদি কেউ তার সঙ্গীর উপর বিশ্বাস গড়ে তলার চেষ্টা করে তবে তার পরবর্তী উপায়গুলি ধীরে ধীরে তাদের সামনে চলে আসবে। তাদের সম্পর্ককে সুন্দর করার জন্য ও তাদের ভেতর অটুট বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য তারা সারাজীবন ধরে কাজ করে যাবে ও তাদের ভালবাসা ও সম্পর্ক আরও দশজনের কাছে উদাহরন হয়ে থাকবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন