শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

বিশ্বাস

       বিশ্বাস মানুষকে, মানুষের জীবনকে কত শান্তি দেয়, পিতা যখন তার সন্তানকে কোলে নিয়ে তাকে উপরে তুলে তার  সাথে খেলা করে তখন সে হাসতে থাকে, সেটা হল সেই সন্তানের তার পিতার প্রতি বিশ্বাস, তার পিতা কখনো তাকে ফেলে দেবে না।
       যখন  চুম্বন করে সে চোখ বন্ধ করে নেয়, এ হল প্রিয়জনের প্রতি তার বিশ্বাস, তার প্রিয় কখনো তার বিশ্বাস ভেঙ্গে দেবে না। যখন পিতা তার কন্যাকে আর একজনের সাথে বিবাহ দিয়ে তাকে বিদায় করে তখন তার চোখে জল আসলেও মনে শান্তি থাকে যে সে তার কন্যার বিবাহ দিয়েছে, সে তার নতুন জীবনে সুখে থাকবে, এটি তার বিশ্বাস। সন্তান যখন স্কুল হতে বাড়ি ফিরে আসে তখন সে জানে বাড়ি গিয়ে তার মার হাতের রান্না খেতে পারবে, এটা হল তার মার প্রতি তার বিশ্বাস। যখন সে প্রথম বার স্কুলে যায় সে ভয় পেলেও তার বাবা মার কথায় সে বিশ্বাস করে তার ভয় দূর করে। কোন নবজাত শাবক বিশ্বাস করে সে তার মার ভালবাসা পাবে, তাই সে তার গর্ভে কত মাস তপস্যা করে, এটি সেই শাবকের তার মার প্রতি বিশ্বাস। প্রতিটি ফুল বিশ্বাস করে কেউ তার কাছে এসে তার পরাগসংযোগ করবে, তাই সে প্রতিদিনই ফুটে ওঠে, এটি সেই ফুলের বিশ্বাস।

এই পৃথিবীতে প্রত্যেকে কাউর উপর বিশ্বাস করেছে এবং তার সেই বিশ্বাসই তার জীবনদেবতা হয়ে তাকে তার জীবনে শান্তি দিয়েছে। সেই বিশ্বাস কোন মানুষ করুক, কোন প্রাণী করুক, আর প্রকৃতিই করুক। এই বিশ্বাসই আমাদের সজ্বল কিশলয়ের মনকে উজ্বল করে, খর্ব হতে দেয় না।  তবে এখন মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে পারে না, নিজের মনকে বিশ্বাসের শান্তি দিতে পারে না বা তার মন বিশ্বাস করার শান্তি পায় না। আমরা আমাদের মনকে বিশ্বাসের সুখ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছি তাকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতে শিখিয়েছি। প্রথমে বিশ্বাস করে সন্দেহকে দূর না করে প্রথমে সন্দেহ করে, যাচাই করে, নিরীক্ষন করে বিশ্বাস করতে শিখেছি। যার ফলে আমরা নিজের মনকে তার স্বাভাবিকতা থেকে, তার সহজ গুন থেকে তাকে অপ্রকৃতিক এবং কৃত্তিম একটি মনে পরিনত করেছি। মানুষ এখন নিরীক্ষন করে তাকে বিশ্বাস করার আগে। বিশ্বাস পেতে হলে সে মানুষকে এক পরীক্ষা দিতে হয়।

কখনো দুজন মানুষের মধ্যে এক সম্পর্ক গড়ে উঠল বিশ্বাস ছাড়া। তারা ভাবল প্রথমে একসাথে থেকে পরস্পরকে নিরীক্ষন করে তারপর বিশ্বাস করবে। তাই সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরও, বিবাহ হয়ে যাবার পরেও যে সময়টুকু তাদের  একে অপরের সঙ্গে কাটানো উচিত, সেই সময়টুকু তারা শুধু একে অপরকে চিনতে ও বুঝতে কাটিয়ে দিয়েছে। আর ঠিক একভাবেই তারা তাদের জীবনের এই অমূল্য সময়কে হারিয়ে ফেলছে। সম্পর্কবন্ধনে একজনের কাছে এসে তাকে চিনে তার উপর বিশ্বাস করার চেয়ে প্রথম তাকে বিশ্বাস করে তাকে চিনবার বা বুঝবার চেষ্টা করাই ভালো।

বিশ্বাসের পরীক্ষায় কেউ সফল হতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বাসের প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে যা হবে তার কাছে তার উত্তর আলাদা হবে।  অবশেষে দুজনেই বিশ্বাসেই সুখ তাদের জীবন থেকে হারিয়ে ফেলবে। আজ আমি একজনকে বিশ্বাস করলাম কাল সে সম্পুন্ন অন্য মানুষ রূপে আমার কাছে আসল তখন কী তার জন্য আমি আমার এই বিশ্বাসকে দোষ দেব ? সে দোষ বিশ্বাসের দোষ নয়। আমি তার উপর বিশ্বাস করেছি আমার সুখের জন্যে কারন আমি আমার মনকে দুঃখ দিতে চাই না, তাকে বিশ্বাসের শান্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাই না, তাই আমি বিশ্বাস করেছি। তবে সে বিশ্বাসের উপর সফল হয়নি। যদি সে সফল নাও হয়ে থাকে তবে দুঃখ হবে না কারন আমি তার অপর বিশ্বাস করেছি, সে আমাকে বিশ্বাস করতে বলেনি, তাকে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত আমার।  সে যদি বিশ্বাসে না করতে পারে তবে আমি এখন তাকে আর বিশ্বাস করতে শেখাব। একজন মানুষ যদি বিশ্বাস না রাখার মনভাব নিয়েও আমার কাছে আসে যদি আমি তার অপর বিশ্বাস করি, সে বদলে যাবে। আলোর কাছে অন্ধকারের কোন শক্তি নেই অন্ধকার কখনো আলোকে দূর করতে পারে না, তবে সেখানে একটু মাত্র অগ্নি শিখা সারা ঘরের অন্ধকারকে দূর করতে পারে। হাজার অবিশ্বাসের অন্ধকারকে শুধু মাত্র বিশ্বাসের আলো দিয়ে দূর করা যায়।

কোন ব্যক্তি যদি সম্পর্কে এসে শুধু সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে তবে আর একজন যদি তাকে বিশ্বাস করে, তাকে ভালবাসে তবে সেই ব্যক্তির অবিশ্বাস ও তার ভালবাসার কাছে কে জিতবে ? সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে সে সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে অনুভব করবে তবে তার সঙ্গী  শুধু তার বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে অনুভব করবে। যা সে ব্যক্তি কখনো অনুভব করতে পারেনি। তার সঙ্গী তাকে ভালোবেসে যে সুখ পেয়েছে, বিশ্বাস করে যে শান্তি পেয়েছে তা সেই ব্যক্তিকেও বিশ্বাস করতে ও ভালবাসতে শেখাবে। সেই ব্যক্তির মুখে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ছবি ফুটে উঠবে তবে তার সঙ্গী তাকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে আরও সুন্দর হবে। বিশ্বাসের কাছে সেই ব্যক্তির সন্দেহ হার মানবে। তার প্রতি তার সঙ্গীর বিশ্বাস তাকে বদলে দেবে। সে তখন বিশ্বাস করতে শিখবে। বিশ্বাস যখন করা হয় তখন অবিশ্বাস হেরে যায়। অবিশ্বাস করে না আমার ভালো হয় না তার, হয় শুধু দুজনার মনের ক্ষয়।

তুমি পড়াশুনা শিখেছ,
তুমি নিজের পরিচয় পেয়েছ,
তবে বিশ্বাস করেছ ?
কারোর চোখে তোমার ক্ষতি দেখেছ,
সম্পর্কে শুধু তোমার স্বার্থ খুজেছ,
তবে সুখের স্বার্থে বিশ্বাস করেছ ?
কখনো বিশ্বাস করে দেখ,
জীবনে সময় অনেক চলে গেল,
একবার বিশ্বাস কর !
জানো না কখন সে সময় শেষ হয়ে যাবে।

যদি জীবনে কখনো অচেনাকে বিশ্বাস না করতে শেখ, মৃত্যুর কানাতে দাড়িয়ে যখন জীবনকে  দেখবে তখন দেখতে পাবে না জীবনে কত আয় করেছি, জীবনে কত প্রতিশোধ নিয়েছি, জীবনে কত লাভ করেছি। দেখতে পারবে জীবনে কত বিশ্বাস করেছি, জীবনে কত ভালোবেসেছি, নিজের বিশ্বাস দিয়ে অবিশ্বাসকে কী জয় করেছি ? বিশ্বাস দিয়ে অবিশ্বাসের অন্ধকারকে  আলোকিত করেছি ?

যেমনভাবে বিবাহ শুধু তোমার জীবনে তোমার প্রয়োজনকে সাথে নিয়ে আসে না, তোমার প্রিয়জনের মাধুর্য, তার সৌন্দর্য তোমার জীবনে তার প্রাধান্য, তোমার প্রয়োজনগুলি মিটিয়ে আসে। ঠিক সেরকম বিশ্বাস শুধু বিশ্বাসকে নিয়ে আসে না, বিশ্বাস শান্তিকে নিয়ে আসে, বিশ্বাস ভালোবাসাকে নিয়ে আসে, বিশ্বাস সময়কে সফল করে, বিশ্বাস মানুষকে সুন্দর করে। মানুষ তো এখন বিশ্বাস করতেই পারে না বিশ্বাস অর্জন করার পরীক্ষায়, নিরীক্ষায় সে তার জীবনের অর্ধেক সময়ই কাটিয়ে দিয়েছি আর যদিও সে এটুকু বিশ্বাস করতে পারল তবে সে বিশ্বাসকে হারিয়ে ফেলে সমাজ ও মানুষের প্রভাবে। যদিও দুজন মানুষ বিশ্বাস করতে পেরেছিল তবে সামান্য কিছুর জন্য সে বিশ্বাস কিভাবে ভেঙ্গে যাবে, যেখানে বিশ্বাস করাই তার কাছে সহজ হয়ে ওঠে না, যেখানে বিশ্বাস তার মনের গুনই হয়ে উঠতে পারে না, সেখানে বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়া খুব সহজ। যেমন রঙ কাপড়ের আসল পরিচয় নয় তাই সূর্যের আলোর সামনে তা বর্নহীন হয়, তেমনি বিশ্বাস যখন আমাদের মনের সহজ গুন হয়ে উঠতে পারে না, সে বিশ্বাস মানুষ, সমাজ পরিস্হিতি, ও সামান্য শক্তির প্রভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্বাসের উপর সম্পর্কের রঙ নয় বরং যে সম্পর্কের উপর যার বিশ্বাসের রঙ তার বিশ্বাস সমাজ, পরিস্হিতি ও মানুষের প্রভাবে তো নষ্ট হবেই। প্রথমে বিশ্বাস করতে শিখে বিশ্বাসকে নিজের রং নয়, বরং নিজের মনের পরিচয় তৈরী করতে হয়।

বিশ্বাস মানুষের মনের সহজ গুন, যেমনভাবে ভাবমান কোন নৌকা জলের ওপর কখনো স্থির থাকে না, কারন নৌকার সহজাত স্বভাব হয় জলের অপর ভেসে যাওয়া, তেমনি মানুষের সহজ গুন বিশ্বাস করা জীবনের স্রোতে, ভালবাসার স্রোতে, বিশ্বাসের হাত ধরে জীবনে এগিয়ে যাওয়া। সেই বিশ্বাসকে এখন নিজের রঙ বানিয়ে নিলে তা ফিকে হয়ে যাবে বরং নিস্বার্থ বিশ্বাসকে নিজের স্বভাব বানিয়ে নিয়ে, তার হাত ধরে জীবনে চলতে হবে। এই বিশ্বাসকে মনের মধ্যে বন্ধ করে রেখে মনের বাচ্চা মানুষকে অনেক দিন ধরে হাসতে দেয়নি। এখন সে বিশ্বাস করে মানুষের কাছে এসে হাসতে শিখবে, সে বিশ্বাস করে শান্তি পাবে।

জানি না আজ  বিশ্বাস মানুষের জীবনের কতটা জায়গা জুড়ে আছে এবং সেই বিশ্বাসের কাছে এই বিশ্বাসের প্রবন্ধ জায়গা কতটা পাবে। মানুষ যদি তার বিশ্বাসের অমূর্ত প্রতিমাকে মূর্তি দিতে চায়, মানুষ যদি তার বিশ্বাসের গুনে মানুষকে গন্ধ দিতে চায় তবে সে নিজেই লেখে তার বিশ্বাসের প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধ আর কাউর কাছে সত্য না হলেও তার সেই বিশ্বাসের কাছে সে সত্য, সে সাক্ষী , সে পূর্ণ। যার কাছে বিশ্বাস করা সহজ তার কাছে তার বিশ্বাসের প্রবন্ধ কঠিন হয় না।  প্রবন্ধ বোঝা কঠিন হয় না, বিশ্বাস করা যার স্বাভাবিকতা, তার কাছে তার বিশ্বাসের প্রবন্ধ অস্বাভাবিক হয় না, সে তার বিশ্বাসে বেচে না থেকে, কেউ বিশ্বাসের কাব্য লিখতে পারে না, যদি না সে তার অন্তর থেকে তার বিশ্বাসকে দেখতে পায়। বিশ্বাসে বেচে থেকে সে তার অন্তরে দেখতে পারে তার বিশ্বাসে সে কতটা শান্তিতে আছে, কত সুখে আছে, কত আনন্দে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন